সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

অপেক্ষা

মজনু ডাকাতের হাত কেটে নেয়া হবে। শিবপুর গ্রামে এই নিয়ে চলছে ব্যাপক আয়োজন। সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহের কমতি নেই। ছোট-বড় সবাই গোল হয়ে ঘীরে রেখেছে মজনু ডাকাতকে। তাকে পিঠমোড়া করে বাঁধা হয়েছে একটি আম গাছের সাথে। এই আম গাছকে ঘীরেই সবার গোল আয়োজন। আমগাছে শীতের শেষের নতুন মুকুল। চারপাশে সেই নতুন মুকুলের একটা মন মাতানো গন্ধ। মজনু ডাকাতের মাথা  কিছুটা নিচের দিকে ঝুলে আছে। তার চোখ খোলা না বন্ধ তা অনুমান করা যাচ্ছেনা। 
গোল জনতার একটু দূরেই আরেকটি গোল আয়োজন। তবে ওখানে লোক সংখ্যা জনা পাঁচেক। তাদের মধ্য মণি নুরুদ্দিন শেখ ওরফে নুরু শেখ। মজনু ডাকাত গতকাল রাতে নুরু শেখের বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পরে। ডকাত দলে ছিল ছয়জন। গ্রামের লোকজন টের পেলে পাঁচজন পালিয়ে যায়। নুরু শেখের হাতে ধরা পরে মজনু ডাকাত। তাদের দলের সর্দার কে তা এখনো যানা জায়নি। ধরা পরার প্রথম দিকে গনপিটুনিতে মজনু ডাকাতের অবস্থা শোচনীয়। সবাই তাকে মেরেই ফেলতো। নুরু শেখ বাঁধা দিয়েছে। উত্তেজিত জনতাকে বুঝিয়েছে- লাত্থি-ঘুসিতে ডাকাত মারবানা। ডাকাতের শাস্তি হইবো আরব নিয়মে। দুই হাত কাইটটা ফালাও। বান্ধো অরে আমগাছের লগে।
জনতা নুরু শেখের আদেশ পালন করেছে। সকাল থেকে ভীর বাড়তে থাকে আমগাছকে ঘীরে। সবার চোখে-মুখে কৌতূহল আর প্রশ্ন। হাত কি সত্যি সত্যি কাঁটা হবে? কখন কাঁটা হবে? কাটবে কে?
হাত কাটবে দাসু পাগলা। তাকে পাশের গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার হাত কাতার বিষয়ে ভাল দক্ষতা রয়েছে। এক সময় সে নিজেও নামকরা ডাকাত ছিলো। একটানা বিশ-পচিশ বছর সে ডাকাতি করেছে। শেষ পাঁচ বছর অবশ্য সে ডাকাত দলের সর্দারের দায়িত্ব পালন করেছে। গত বছর তিনেক হল সে আর ডাকাতি করেনা। পাগল বেশে ঘুরে বেড়ায়। তবে সে আসলে পাগল না। সে যে পাগল না তার বহু প্রমান আছে। তবে এই মুহূর্তে একটি প্রমান দেয়া যায়। সে আজ মজনু ডাকাতের হাত কাটবে। পাগল মানুষকে দিয়ে আর যাইহোক মানুষের হাত কাটানো যায়না। পাগলদের সাহস কম থাকে। তারা  রক্ত দেখে ভয় পায়। 
নুরু শেখ একটি হাতলবিহীন লাল প্লাসটিকের চেয়ারে বসে আছে। তার পায়ের কাছে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে দাসু পাগলা। তার চোখমুখ নির্বিকার। সে সেই নির্বিকার চোখে তাকিয়ে আছে তার সামনে রাখা      রামদা টার দিকে। রামদা'টা আনা হয়েছে মজনু ডাকাতের হাত কেটে ফেলার জন্যে। তবে এই দা'য়ে হাত কাটবে কিনা সেই  ব্যাপারে স্বয়ং দাসু পাগলারই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সে নুরু শেখের অনুমতির অপেক্ষায় আছে। অনুমতি পেলেই সে মজনু ডাকাতের হাত কাটবে। নুরু শেখ এখনো অনুমতি দেননি। তিনি এ বিষয়ে আগে মৌলানার সাথে কথা বলে নেবেন। মৌলানাকে ডাকা হয়েছে। গ্রামের বড় মসজিদের ইমাম আসছেন নুরু শেখের সাথে কথা বলার জন্য। 
মাঝখানের এই সময়টুকু মজনু ডাকাতের বাড়তি পাওয়া। যদিও সে মৌলানার ব্যাপারটি জানেনা। সে অপেক্ষায় আছে কখন তার হাত কাটার হুকুম আসে। তবে একটি বিষয়ে সে কিঞ্চিত চিন্তিত। তার একটি হাত কাটা হবে না দুইটিই। এ বিষয়টি সে অনুমান করতে পারছেনা। অবশ্য অনুমান করার শক্তিও তার খুব একটা নেই। তার সারা শরীর ঝিম ধরে গেছে। সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তার চারপাশের গোল জনতার ভিতর থেকে হালকা গুঞ্জন তার কানে আসছে। কেউ একজন বলছে-হাত কাইটলে বাচবোনি? বাচবোনা মনে অয়। অন্য আরেকজন বলছে--মরুক। মইল্লেই শান্তি। কাটা হাত দিয়া করবো কি? জনতার কথাগুলো মজনু ডাকাতের কানে ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে সে ঘুমের দিকে যাচ্ছে। পুরোপুরি ঘুমিয়ে পরার আগে সে গোল জনতার উচ্চস্বরে কথাটি শুনতে পেল-মৌলানা আইছে! মৌলানা আইছে!

বুধবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৩

আহা আজ মন কেমন করে।

শীতের বিকেলগুলো একটু কেমন যেন। খুব নিঃসঙ্গ আর একাকীত্তে ভরা। ভীষণ খারাপ লাগা এক একটি মুহূর্ত। আমি খুব সচেতনভাবেই লক্ষ্য করেছি, গ্রীস্মের বিকেলগুলোর চাইতে শীতের বিকেলগুলোতে কেন জানি বেশি অতীতকে মনে পড়ে। সেই কোথায় কবে কোন ছেলেবেলায় মামা বাড়ির দারোয়ান জহু মোল্লার সাথে শুক্রবারের হাঁটে গিয়ে গরম গরম জিলাপি খেয়েছি, সেই কথা এই এতদিন পর এসে, শীতের এই নিঃসঙ্গ বিকেলে কেন মনে পড়বে? কেন মনে পড়বে স্কুলে যাবার সময় রাস্তার ধারের সেই ছোট্ট খুপরির ভিতর থেকে বের হয়ে আসা আমার ক্লাসের সহপাঠী মোনাক্কার কথা? কত সকাল যে ও আর আমি হেঁটেছি ঐ পথে! হাটতে হাটতেই মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত পাল্টেছে আমাদের। এর জন্য অবশ্য আমিই একটু বেশি দায়ী ছিলাম। বকুল গাছতলায় ফুল কুড়ানোর জন্য ওকে যদি ঐভাবে টেনে না ধরতাম, তবে কি আর ঐ দিনের স্কুলটা কামাই যেত? কোন কোন বিকেলে অদ্ভুত জিদ চাপত মাথায়। আকাশ ছোঁয়ার জিদ। দূর দিগন্তে যেখানে আকাশ মাটিকে ছুঁয়ে ফেলেছে সেখানে গিয়ে আকাশ ছোঁয়ার জন্য কতদিন যে হাঁটা ধরেছি। শেষে ক্লান্ত হয়ে বিষণ্ণ মন নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
ঐ সবকিছুই আজ এই শিতের অবেলায় কেন এত মনে পরে পরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি? আহা! কত রঙিনই না ছিল দিনগুলি। কত কিছুই না ছিল দিনগুলিতে। কাগজের ক্যামেরা ছিল। ম্যাচ বক্সের টেলিফোন ছিল। সিগারেটের বাক্সের টেলিভিশন ছিল। বাই-সাইকেলের টিউবের গুলতি ছিল। গাছের ডালের তৈরী বক পক্ষী ধরার ফাঁদ ছিল। মাছ ধরার ছিপ ছিল। শুক্রবারের জিলাপি ছিল। পথের ধারে মোনাক্কা ছিল।
আজ এই কিছুই না থাকার বিকেলে তাই কী এত করে সব ছিলগুলোর কথা মনে পরে অহেতুক মন কেমন জানি করে ওঠে? কী জানি, কে জানে!

শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

চিরকুট

ছেলেটি বলল, ভাইজান খায়া যান।
আমি প্রশ্ন করলাম, তুই খাইছস?
ছেলেটি মাথাটা নিচের দিকে নামালো। মাটির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে শব্দ করলো, না।
আমি ধমকের স্বরে বললাম, তাহলে আমাকে কেন খেতে বলছিস?
ছেলেটি মনে হয় একটু ভড়কে গেল। মাথা তুলে আবার আমার দেকে তাকিয়ে বললো, আমার তো ক্ষুধা নাই।
লক্ষ্য করালাম ছেলেটির ঠোঁট কাপছে। ওর চোখে কি পানি? আমি দ্রুত অন্যদিকে তাকালাম। ওর চোখে পানি কিনা তা আর ভাল করে লক্ষ্য করার ইচ্ছা হচ্ছিলোনা আমার। পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যপার আছে যা এড়িয়ে যেতে পারলেই স্বস্তি।